২ মার্চ ১৯৭১ -প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে । ঘটনাটি নিয়ে ভাবতেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি নিজে মনের ভেতর পাক খায়, সেই অনুভূতিটুকু যে গর্বের সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। বই পড়ে যতটুকু জেনেছি , পাকিস্তানের শাসক গোষ্টি তখন মোটেও সহজ কিছু ছিল না। তারা ঘৃণার বিষপাত্রের সবটুকু নিঃশেষ করে ঢেলে দিয়েছিল বাঙালিদের উপর। তাদের মানবিক দীনতা স্পষ্ট হয় ৪৮ এর ভাষা সংকট থেকে শুরু করে ২৫ মার্চ-এ পশুত্বের সীমা ছাড়িয়ে।
৭১ কোন ছেলেখেলা একটি বিষয় নয়, ভুলবার তো নয় বটেই। মানুষ মানেই বৈচিত্র্য থাকবে, মতের পার্থক্য হবে, প্রত্যেকেই নিজের মতমত নিয়ে হেঁটে যাবে। কিন্তু স্বাধীনতা, এই একটি মাত্র শব্দের জন্যে ৭ কোটি বাঙালীর ঐক্য রূপকথার গল্পে নয়, বাস্তব সত্য একটি ঘটনা, যার দৃষ্টান্ত অনেক বেশি পাওয়া যাবে এমন মনে করি না।
২৫ মার্চের রাতের কথায় ভাবুন। রাতের অন্ধকার সুনসান তারার আলোয় বাতাসে প্লেগের মতো ভয় ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। একদঙ্গল মনুষ্যত্বহীন, বিবেকবর্জিত, মস্তিষ্কবিহীণ দুপেয়ে প্রাণি ট্যাংক নিয়ে যাত্রা করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। তারা ভেবেছিল কিছুক্ষণ পরেই সুর সুর করে নেমে এসে নতজানু হয়ে হাটু গেড়ে বসে যাবে তাদের সামনে সব ছাত্ররা, তারা ভুল করেছে এইবলে প্রাণ ভিক্ষা চাইবে। কি অসীম সাহস তাদের, কেও আত্মসমর্পণ করে নি, বরং লাঠি নিয়ে রুখে দাড়িয়েছে, যেন তারা জানতো এই দিন দিন নয় আরও দিন আছে। তার ভুল করেনি, নির্ভীক থেকে আকাশের সহস্রকোটি নক্ষত্রের মাঝে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে ।
১৬ ডিসেম্বর এ আত্মসমর্পণ করার সব আনুষ্ঠিকতা শেষ করে নিয়াজী নাকি ভারতীয় জেনারেলকে প্রশ্ন করেছিল, “বলুন তো এই যুদ্ধ আমরা কি যথেষ্ট সাহসের সাথে লড়ি নি? পাঁঠার মতো প্রশ্ন। সাহসিকতা কাকে বলে তা বাঙালিরা হারে হারে তাদের দেখিয়ে দিয়েছে। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ভুট্টো যখন তার শেষ চালটি চালতে চেয়েছিল, বঙ্গবন্ধু তার হাতে বন্ধী থেকেও তা হতে দেন নি। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুতি নিতে নিতে দীর্ঘ নয় মাস কারাগারের নিকৃষ্টতম প্রকোষ্টে থেকেও কোনও মুহুর্তেও ভেঙ্গে পরেন নি, তাদের সাথে কোন রকম সমঝোতা করেন না, সপ্তাতের পর সপ্তাহ কোন বাক্য ব্যয় না করে কাটিয়ে দিয়েছেন । এর থেকে বড় সাহসীকতা, ধৈর্য কেও দেখিয়েছে কখনো ?
বাঙ্গালী ৪৮, ৫২, ৬৯, ৭১ এর সেই সাহসীকতার মহাকাব্যের শেষ কখনই হবে না।
এতো শত সাহসীকতা আর বিজয়ের গল্পগাথা আমাদের থাকলেও মাঝে মাঝেই মনের ভেতর অদ্ভুত রিনিরিন ভাব চলে আসে, একরাশ কুয়াশা যেন ভেতরটা ভিজিয়ে দেয়, মনটা খারাপ হয়ে যায়। এই গল্পগাথা গুলো নিয়ে আমরা কথা বলি না, এগুলো খাবার টেবিলের গল্পের বিষয় বস্তু হয়ে উঠে না। বরং কেও কেও এগুলো নিয়ে পশ্ন করে, বিশ্বাস করতে চায় না, রূপকথার গল্পের মত হালকা ভেবে হেসে উড়িয়ে দেয়।