ইউএস ইলেকশন নিয়ে পুরো দুনিয়াতে মোটামুটি আলোচনা হয়, এর কারণ সম্ভবত দুটি । এক, অনেক লম্বা সময় ধরে প্রচার প্রচারণা চলে। আরেকটি হচ্ছে পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ মজার এবং চিত্তবিনোদনকর। ব্যপারটি এমন যে, দুই পার্টির পার্থীদের ডিবেইট শুনলে স্ট্যান্ডআপ কমেডি শুনার দরকার পরে না, প্রত্যেকেই একেকজন কমেডিয়ান।
যথারীতি আমিও অনেক দিন থেকেই ফলো করছি। ডোনাল্ড ট্রাম্প একটা পরিচিত নাম। হেইটফুল রেটরিক (hateful rhetoric) এর জন্যে বিখ্যাত ইতিমধ্যে। যদিও সে রিপাবলিকান নমিনি (মোস্ট লাইকলি), কিন্তু ব্যপারটা কেও যেন ধর্তব্যের মধ্যে রাখছে না। মোটামুটি সবাই ধরে নিয়েছে নেক্সট আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন। আমার ব্যক্তিগত পছন্দ যদিও বার্নি স্যান্ডার্স। অনেকের মতে ডেমক্রেটিক ইলেকশনে হিলারি বোধহয় একটা বাজে উদাহরণ।
তারপরে আমেরিকায় প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট ব্যাপারটি অনেক দিক থেকেই চমৎকার। এর আগে এই রকম ব্যপার কখনোই হয়নি। সুতরাং এটি নিশ্চয় এক নতুন দ্বার খুলে যাচ্ছে। ওমেন এমপাওয়ারমেন্ট নিয়ে আজকাল সবাই কথা বলে, সুতরাং নি:সন্দেহে এটি একটি ভাল দিক। আমার এই নতুন দ্বার খুলে যাওয়া নিয়েই কয়েকটি কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছে।
তবে শুরুতে বলতেই হবে যে দুনিয়াতে মানুষ গুলো অদ্ভুত। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড সর্বত্র। আমরা গর্ব করি এই বলে আমাদের জানাশোনা জগতের মধ্যে মানুষের মস্তিষ্ক সবচেয়ে অতুলনীয়, কিন্তু সেই মস্তিষ্ক না ব্যবহার করে নানা রকম ননসেন্স এর সাথে ক্যারিডআউট হয়ে যাই, তখন বিষ্ময়ের সীমা-পরিসীমা কিছুই থাকে না। একটা সময় ভাবতাম ব্যাপারটা শুধুমাত্র শিক্ষার অভাবে হয়। কিন্তু ইতিহাস থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শিক্ষা থাকলেও প্রকৃত শিক্ষার অভাব তো আছে বইকি, যে সব সমাজকে আমরা সভ্য, প্রগ্রেসিভ বলে জানি, তাদের মাঝেও যখন চরম রেসিজম দেখা যায়, তখন সব কিছু অন্যরকম লাগে।
খুব বেশিদিন আগের ঘটনা না। সম্ভবত আমরা সবাই ২০১২ সালের অক্টোবর মাসের অস্ট্রেলিয়ান প্রাইম মিনিস্টার এর সেই বিখ্যাত মেসাজিনি স্পিসটি শুনেছি। জুলিয়া গিলার্ড, ফরমার প্রাইম মিনিস্টার অব অস্ট্রেলিয়া, যা অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে একটি বিশাল মাইলস্টোন। অস্ট্রেলিয়া ১৯০১ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে গত ১১০ বছর তাদের শাষণ ব্যবস্থা ছিল মেইল ডমিনেটেড। ২০১০ সালে এর সমাপ্তি ঘটে। অস্ট্রেলিয়ার শাষন ব্যবস্থা ইন্টারেস্টিং। এটি একটি ফেডারেল পার্লামেন্টারি কনস্টিটিউশনাল মনার্কি। মনার্কি শুনলেই যে ব্যপারটি মাথায় আসে, সেটি হলো, একজন রাজা বা রাণী থাকবে যার মাথায় ক্রাউন থাকবে এবং সে সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু কনস্টিটিউশনাল মনার্কি ব্যপারটি অনেকটা সেরিমনিয়াল। তাদের কোন পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড থাকে না। তারা কোন রুলস এবং রেগুলেশান পরিবর্তন করতে পারে না। কিং বা কুয়িন হেড অব স্টেট হলেও গভার্মেন্ট এর হেড হয় প্রাইম মিনিস্টার অথবা যে পার্লামেন্ট এর লিডার। কুইন এলিযাবেথ-II কে আমরা সবাই চিনি। টেকনেক্যালি কুইন এলিযাবেথ সবগুলো কমনওয়েল্থ দেশ গুলোর কুইন বা হেড অব স্টেট। যদিও তিনি এসব দেশের জন্যে কিছু করেনা না, এসব দেশে একজন গভর্নর জেনারেল থাকে, সে তার কাজ গুলো করে থাকে। যাহোক মূল বিষয় হলো, অস্ট্রেলিয়া যেহেতু কনস্টিটিউশনাল মনার্কি, সেহেতু এর হেড অব স্টেট হচ্ছে কুইন এলিযাবেথ, এবং তার কাজ গুলো করে থাকে একজন গভর্নর জেনারেল। ২০১০ সালে প্রাইম মিনিস্টার নির্বাচিত হয় জুলিয়া গিলার্ড। জুলিয়া গিলার্ড একজন টাফ, ওয়িপস্মার্ট(whip-smart) মহিলা। ঠিক তখন অস্ট্রেলিয়ার গভর্নর জেনারেল ছিলেন একজন মহিলা (Quentin Bryce), যিনি নিজেও একজন প্রথম মহিলা গভর্নর জেনারেল। ঠিক এজন্যেই Swearing in Ceremony টি ছিল এক বিশেষ ব্যপার। একজন প্রথম মহিলা গভর্নর জেনারেল একজন প্রথম প্রাইম মিনিস্টারকে শপথ বাক্য পাঠ করানো নি:সন্দেহে একটি আশ্চর্যজনক ঐতিহাসিক ঘটনা। এবং সবাই ধরেই নিয়েছিল যে, মহিলাদের জন্যে যে দ্বার অনেক বছর ধরে বন্ধ ছিল তা খুলে গেল। সামনে আসছে এক বিশাল পরিবর্তন।
এখানে আমরা সবাই জানি যে, প্রাইম মিনিস্টার একটি পদমর্যাদা। জেন্ডার এখানে কোন রুল প্লে করে না। মহিলা হলেও তিনি প্রাইম মিনিস্টার এবং পুরুষ হলেও প্রাইম মিনিস্টার। জুলিয়া গিলার্ড এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমন থাকে নি। তার অফিসের দ্বিতীয় বছর শুরু হতেই ঘটনা কুৎসিত হতে শুরু করে। অপজিশন পার্টি তার নামে ভয়ংকর কুৎসিত কথা বলা শুরু করে। ডিচ দি ওয়িচ বলে মানুষজন স্লোগান শুরু করে। তার অপোনেন্ট তার নুড সেক্সুয়াল কার্টুন সার্কুলেশান শুরু করে। মিডিয়া গুলো এমন ভাবে লিখে যেন সে কোন হেড অব গভারমেন্ট নয়, রিয়েলিটি টিভি স্টার, তার আউটফিট নিয়ে লেখা লেখি করে। ঘটনা আরও জগণ্য হতে শুরু করে।
একটি প্রগ্রেসিভ দেশে ইন্টেলিজেন্ট এডুকেডেট পার্লামেন্ট মেম্বার গুলো যদি একজন মহিলা প্রধাণমন্ত্রী নির্বাচিত করে নিজেদেরকে প্রগ্রেসিভ দাবি করে, তাহলে তাদের আচরণ থেকে তা মোটেও প্রমাণ পাওয়া যায় না। ইউটিউবে তাদের আচরণের অনেক কিছু পাওয়া যায়, যেগুলো আমি উল্লেখ করতে চাই না।
একদম শেষের দিকে গিলার্ড পার্লামেন্ট এ একটি বিশেষ স্পিস দেয়, যা কিনা তার বিখ্যাত মেসাজিনি স্পিস যা কিনা টনি অ্যাবট (অপজিশন পার্টি লিডার ) কে উদ্দেশ্য করে দেওয়া। আমি আর এখানে ডিটেইল এ গেলাম না।
মজার ব্যপার হচ্ছে Tony Abbott তার এহেন মেসাজনিস্টিক হওয়ার পরেও পরেরবার প্রাইম মিনিস্টার নির্বাচিত হয়। এমন প্রগ্রেসিভ দেশে এগুলাে কিভাবে খুব সাধারণ ভাবেও নিয়ে নেয় তা ভাবতেই অবাক লাগে।
সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতে আর কখনো অস্ট্রেলিয়াতে ফিমেইল প্রামই মিনিস্টার কেও হতে যাচ্ছে না।
মিডিয়াগুলো কিভাবে কাজ করে আমরা মোটামুটি সবাই ইতিমধ্যে জেনে গেছি। ভাল ভাল খবরে তাদের কাটতি নেই, সুতরাং রসাল নোংড়া খবরে তাদের আকর্ষণ বেশি। মানুষের রূচিবোধ নিয়েও আমার বিষ্ময়ের সীমা নেই।
তার একটি প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে নিচের একটি ভিডিওটিতে।
মানব প্রজাতি বড়ই অদ্ভুত। এমন প্রগ্রেসিভ দেশে এতো শিক্ষিত, ভদ্র বুদ্ধিমান মানুষগুলো একজন মহিলা প্রাইম মিনিস্টার সহ্য করতে পারেনি।
হিলারি ক্লিনটন এর ব্যপারেও কি এমন হবে ? হতেই পারে যে বারাক ওবামা প্রথম এবং শেষ ব্ল্যাক প্রেসিডন্ট, হিলারি ক্লিন্ট প্রথম এবং শেষ মহিলা প্রেসিডেন্ট অব ইউনাইটেড স্ট্যাটস অব আমেরিকা।
ব্রাজিল, ইউনাইটেড কিংডম, জার্মানী, ক্রোয়েশিয়া, পাকিস্তান এসব দেশেও মহিলা লিডার নির্বাচিত হয়ে ছিল যা কিনা একবারই, এর পর আর কখনো হওয়ার সম্ভবনা দেখা দেয়নি।
তবে আমি মানুষ হিসেবে অপটিমিস্টিং, বাংলাদেশে বহু টার্ম ধরে মহিলা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে আসছে । সুখের ব্যপার এই যে বাংলাদেশে দারিদ্রতা ও শিক্ষার অভাব থাকলেও এমন মেসাজনিস্টিক কেও নেই যতটা সেইসব প্রগ্রেসিভ দেশ গুলাতে দেখা যায়।
আমি আমার দেশ নিয়ে আশাবাদী। অনেক বেশি।
বন্যকবলিত এলাকায় যখন ফ্লোটিং স্কুল দেখি
https://www.facebook.com/aljazeera/videos/10154390986158690/?pnref=story
তখন মন ভরে যায়। যখন স্ট্যাটিসটিকস দেখি বাংলাদেশের গড় আয়ু বৃদ্ধির, শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, পার ক্যাপিটা আয় বৃদ্ধি ইত্যাদি, তখন দেশ নিয়ে গর্ব করতে বাধা কোথায়। একদিনে লাফ দিয়ে উন্নত হওয়া যাবে না সত্যি, তবে এর গতি আরও বৃদ্ধি হোক, এই প্রত্যাশা।